চিংড়ির হোয়াইট স্পট ভাইরাসের জিনোম রহস্য উন্মোচন

চিংড়ির হোয়াইট স্পট ভাইরাসের জিনোম রহস্য উন্মোচন

এক শ একর জায়গার ওপর বছর দশেক আগে চিংড়ির ঘের তৈরি করেছিলেন আবদুস সালাম। প্রথম দিকে উৎপাদন কম ছিল, তবে ধাপে ধাপে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন বাড়তে থাকে। কিন্তু এক বছরের মাথায় তাঁর ঘেরের অর্ধেক মাছ হঠাৎ মারা যায়। পরে অন্য চাষিদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানলেন, হোয়াইট স্পট ভাইরাসের আক্রমণে মারা গেছে চিংড়িগুলো।

চলতি বছরের আগস্ট–সেপ্টেম্বরেও তাঁর ঘেরে প্রায় সাড়ে চার হাজার কেজি চিংড়ি মারা গেছে। আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, হোয়াইট স্পট ভাইরাস আক্রমণ করলে ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই চিংড়ি মরে ভেসে ওঠে। এ বছর প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এসব চিংড়ি মারা না গেলে অন্তত ৪০ লাখ টাকা আয় হতো। এখন সেটি ১০ লাখ টাকায় নেমে এসেছে।

শুধু আবদুস সালাম নন, তাঁর মতো কক্সবাজার জেলার এমন আরও সাড়ে চার হাজার চিংড়ি ব্যবসায়ী হোয়াইট স্পট ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। কারণ, এ ভাইরাস আক্রমণ করলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা পড়ছে চিংড়ি। তবে ভাইরাসটির কোন ধরন কীভাবে চিংড়ির শরীরে প্রবেশ করে, ভাইরাসটি কী উপাদানে তৈরি, জিনোম বিন্যাস কেমন, তা এত দিন জানা ছিল না দেশের গবেষকদের।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক চিংড়ির এই প্রাণঘাতী হোয়াইট স্পট ভাইরাসের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন, অর্থাৎ জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন (এনসিবিআই) ও আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজিতে জিনোম সিকোয়েন্সের এসব তথ্য গৃহীত হয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়, চিংড়ির কোষের আনুষঙ্গিক প্রোটিন হিসেবে ‘রেব সেভেন’ নামের পরিবাহক থাকে। এই পরিবাহকের সাহায্যে ভাইরাসটি চিংড়ির দেহের ভেতরে প্রবেশ করে। কোষে ঢোকার পর এই ভাইরাস চিংড়িকে দুর্বল করে ফেলে। পাশাপাশি ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করে। একপর্যায়ে চিংড়ি মারা যায়।

গবেষণা দলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আদনান মান্নান এবং ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের অধ্যাপক এস এম শরীফুজ্জামান ও মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী। আরও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এম এ এম জুনায়েদ ছিদ্দিকী ও আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী এনায়েত হোসেন। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণা কার্যক্রম চলে। কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা থেকে চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণায় যা উঠে এল:
হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস মূলত চিংড়ির গায়ে সাদা বৃত্তাকার দাগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি ছোঁয়াচে রোগ। এই ভাইরাস মূলত ক্রাস্টাশিয়ান (কঠিন আবরণের জলজ প্রাণী) পর্বের প্রাণীগুলোকে আক্রমণ করে। যেমন চিংড়ি, লবস্টার, কাঁকড়া ইত্যাদি। অন্য কোনো পর্বের প্রাণীকে এই ভাইরাস আক্রমণ করে না।

গবেষকেরা জানান, ১৯৯২ সালে চীনের ফুজি রাজ্য ও তাইওয়ানে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণের খোঁজ পাওয়া যায়। পরের বছর জাপানে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া কয়েক বছরের মধ্যে ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

অন্যদিকে ১৯৯৪ সালে কক্সবাজারে একটি হ্যাচারিতে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে চিংড়ি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। দেশে প্রথমবারের মতো সে বছরই এই ভাইরাসের ধারণা পাওয়া যায়। ১৯৯৮ সালে খুলনা অঞ্চলের বেশ কিছু চিংড়ি হ্যাচারিতে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে কয়েক হাজার কেজি চিংড়ি মারা যায়।

অধ্যাপক এস এম রফিকুল ইসলাম ও আদনান মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বিরাজমান হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের প্রকরণ কেমন, চিংড়ির মৃত্যুর ক্ষেত্রে ভাইরাসের কোন বিষাক্ত প্রোটিন বা জিন ভূমিকা রাখে, এটি কীভাবে ছড়ায়, এসব তথ্য জানার উদ্দেশ্যে গবেষণাটি করা হয়। এ ছাড়া দেশে প্রথমবারের মতো ভাইরাসটির জিনোম সিকোয়েন্স করা হলো। এ গবেষণার তথ্য ভাইরাসটি প্রতিরোধের কাজে ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশে ১ হাজার ২৮০টি নতুন মিউটেশন বা জিনের ভিন্নতা পাওয়া গেছে এ গবেষণায়। এ দেশের ভাইরাসের ধরনগুলো অন্য দেশের থেকে ভিন্ন। উৎপত্তিগত বিশ্লেষণ (ফাইলোজেনেটিক ট্রি) ও বিভিন্ন ধরন বিশ্লেষণ (ক্লেড অ্যানালাইসিস) করে গবেষকেরা এ চিত্র দেখতে পান। অধ্যাপক এস এম শরীফুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, পানিতে দূষণ ও পানির বিভিন্ন চারিত্রিক পরিবর্তনের কারণে এই ভিন্নতা পাওয়া গেছে। পাশাপাশি বর্তমানে এই ভাইরাসের একেবারে নতুন ধরনে আক্রান্ত হয়ে চিংড়ি মারা পড়ছে। গবেষণায় বলা হয়, বর্ষাকালে (বিশেষত জুন থেকে আগস্টে) এই ভাইরাস বেশি সংক্রমণ ঘটায়। জিনগত পরিবর্তনগুলোও এই সময়ে বেশি হয়।

উৎপাদনের ২০ শতাংশই নষ্ট হচ্ছে:
দেশে বর্তমানে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী ও ময়মনসিংহে চিংড়ি চাষ হয়। রপ্তানির জন্য ১০৫টি চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৭৬টি ইইউর অনুমোদন পাওয়া। ১০৫টি কারখানার বছরে ৪ লাখ মেট্রিক টন চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা রয়েছে।

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৭ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়। তার আগের বছর উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন। এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ লাখ ৭০ হাজার ১৪ মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়।

গবেষকেরা বলছেন, প্রতিবছর উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ চিংড়ি নষ্ট হয়ে যায় হোয়াইট স্পট ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। টাকার হিসেবে প্রায় শতকোটি টাকা লোকসান গুনছেন চিংড়িচাষিরা।

গবেষক দলের অন্যতম সহযোগী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, চাষপদ্ধতির সব স্তরে জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ বজায় রাখা জরুরি। এ ছাড়া প্রচলিত চিংড়ি চাষের পরিবর্তে আবদ্ধ পদ্ধতিতে আধা নিবিড় চাষ করা হলে দেশে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।

©প্রথম আলো